বৃহস্পতিবার
১৩ই মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২৮শে ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

৩০ হাজারে শুরু, আর কে হান্নানের ব্যবসা এখন অর্ধকোটি টাকার

0Shares

বিশ্ববিদ্যালয়ে সহপাঠীরা যে সময়ে শুধু পড়ালেখায় ব্যস্ত থাকতেন, তখন পড়াশোনার পাশাপাশি ই–কমার্স ওয়েবসাইটে চামড়ার তৈরি বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করতেন আর কে হান্নান। বিভিন্ন জায়গা থেকে চামড়াপণ্য সংগ্রহ করে তা অনলাইনে বিক্রি করতেন তিনি। এ কাজ করতে করতে একসময় নিজেই কারখানা দিয়ে চামড়ার জ্যাকেট তৈরি করতে শুরু করেন। মাত্র ৩০ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে শুরু করা সেই উদ্যোগ এখন প্রায় অর্ধকোটি টাকার ব্যবসায়ে পরিণত হয়েছে।

আর কে হান্নানের প্রতিষ্ঠানের নাম র‌্যাভেন। সম্প্রতি রাজধানীর মিরপুরে র‌্যাভেনের একটি বিক্রয়কেন্দ্রে তাঁর সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়। আলাপচারিতায় তিনি উদ্যোক্তা জীবনের নানা গল্প, চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তুলে ধরেন।

আর কে হান্নান জানান, ছোটবেলা থেকেই তাঁর ইচ্ছে ছিল ব্যবসা করবেন। এ জন্য কর্মমুখী শিক্ষা পাওয়া যাবে, এমন বিষয়েই পড়তে চাইতেন তিনি। যদিও বাবা–মা চাইতেন ছেলে সরকারি চাকরি করবে। যা–ই হোক, উচ্চমাধ্যমিক শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেদার টেকনোলজি ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন তিনি। মূলত এর মধ্য দিয়েই তাঁর জীবনের বাঁকবদল হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় বর্ষে থাকাকালে ২০১০ সালে তিনি নিজে একটি ই–কমার্স ওয়েবসাইট বানান। এরপর রাজধানীর হাজারীবাগ এলাকা থেকে বিভিন্ন চামড়াপণ্য এনে সে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বিক্রি করতেন। অনলাইনে এসব পণ্যের জন্য ক্রেতাদের কাছ থেকে বেশ সাড়া পান। আবার অনেক ক্রেতা কাস্টমাইজড অর্থাৎ, তাঁদের বিশেষ চাহিদা বা পছন্দ অনুযায়ীও পণ্য চাইতেন। সেগুলোও হাজারীবাগের চামড়া কারখানা থেকে বানিয়ে এনে দিতেন হান্নান। এভাবেই চলে তিন বছর। ২০১৪ সালে হান্নানের স্নাতক শেষ হয়। এবার নিজেই চামড়ার পণ্য তৈরির চিন্তাভাবনা শুরু করেন তিনি। তবে কাজটা মোটেই সহজ ছিল না। কারণ, মোটামুটি মানের কারখানা করতেও প্রয়োজন ছিল অন্তত ৫ লাখ টাকা। কিন্তু এত টাকা জোগাড় করা তাঁর জন্য কষ্টকর ছিল। তাই ছোট পরিসরে কাজ শুরু করার পরিকল্পনা নেন তিনি।

শুরুতেই হাজারীবাগ এলাকা থেকে একজন কারিগর নিয়োগ করেন, যিনি চামড়ার জ্যাকেট বানাতে দক্ষ। তাঁর সঙ্গে নেন একজন সহকারী। তাঁদের সঙ্গে চুক্তি ছিল—বিক্রি হলে বেতন পাবেন, না হলে নয়। এরপর একজন নিকটাত্মীয়ের কাছ থেকে মাত্র ৩০ হাজার টাকা ধার নিয়ে রাজধানীর লালকুঠি এলাকায় ছোট্ট একটি ভাড়া দোকানে পণ্য তৈরি শুরু হয়। পণ্যের চাহিদা বাড়ায় এক বছরের মধ্যেই ৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন হান্নান।

প্রতিষ্ঠানের ‘র‌্যাভেন’ নামকরণের পেছনেও আছে গল্প। আর কে হান্নান জানান, তিনি গ্রিক মিথলজি সম্পর্কে পড়াশোনা করেছেন। সেখানে র‌্যাভেন নামে একটা চরিত্র আছে। র‌্যাভেন অর্থ দাঁড়কাক। আবার এডগার অ্যালেন পোরও একটা কবিতা আছে ‘র‌্যাভেন’ নামে। এই দুই চরিত্র হান্নানকে বেশ টেনেছিল। ব্যস, সেটই হয়ে যায় তাঁর প্রতিষ্ঠানের নাম।

এদিকে র‌্যাভেনের তৈরি জ্যাকেটের চাহিদা বাড়তে থাকে। কিন্তু সে অনুযায়ী পণ্য উৎপাদনের জায়গা ছিল না। তাই ২০১৬ সালে কারখানাটি লালকুঠি থেকে সরিয়ে মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরের একটি গ্রামে নিয়ে যান এই উদ্যোক্তা। তবে কারখানা বড় করলে কী হবে, গ্রামে দক্ষ শ্রমিক পাবেন কোথায়? এ নিয়ে সমস্যায় পড়েন তিনি। তখন ওই গ্রামেরই প্রায় ২০ জন নারীকে তিনি এক বছরের প্রশিক্ষণ দেন। ২০১৭ সাল থেকে সেখানে পুরোদমে উৎপাদন শুরু হয়। এরপর থেকে তাঁকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

হান্নান জানান, ২০১৭ সালে তিনি মিরপুর–১ নম্বর মোড়ে প্রথম একটি শোরুম বা বিক্রয়কেন্দ্র ভাড়া নেন। এটি ছিল তাঁর জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ, কর্মীদের বেতন, গ্রাহক পাওয়া, বিক্রয় ও বিপণন কৌশল এসব নিয়ে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল তাঁকে। হান্নান বলেন, ‘তখন থেকেই আমার ব্যবসায়িক পথচলার মূল চ্যালেঞ্জ শুরু হয়। তবে পরিস্থিতি যা–ই হোক, আমার ব্যবসায়ের মূলমন্ত্র ছিল—স্বচ্ছতা।’

এই উদ্যোক্তা জানান, শোরুম খোলার প্রথম দুই–তিন বছর ব্যবসায়ে খুব বেশি প্রবৃদ্ধি হয়নি। এরই মধ্যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয়ে যায়। তখন বেচাকেনা তলানিতে নেমে যায়। তবে ২০২১ সাল থেকে তিনি আবার ব্যবসায়ে ঘুরে দাঁড়ান। ওই বছর তিনি চট্টগ্রামের খুলশী এলাকায় দ্বিতীয় বিক্রয়কেন্দ্র খোলেন। এরপর ঢাকার উত্তরায় একটি বিক্রয়কেন্দ্র চালু করেন।

বর্তমানে চামড়ার জ্যাকেট ছাড়াও নানা ধরনের চামড়ার ব্যাগ, যেমন অফিস ব্যাগ, জিম ব্যাগ, ওয়ালেট, গ্লাভস প্রভৃতি তৈরি করে র‍্যাভেন। হান্নান জানান, তাঁর কোম্পানির তৈরি চামড়ার জ্যাকেটের দাম সাড়ে ১১ হাজার টাকা থেকে সাড়ে ২৩ হাজার টাকার মধ্যে বিক্রি হয়। তবে এর চেয়েও বেশি দামের কিছু পণ্য তৈরি করেন তাঁরা। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে ২০ জন নিয়মিত কর্মী আছেন। অস্থায়ী ভিত্তিতে আরও কিছু কর্মী কাজ করেন। এ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটিতে বিনিয়োগ করা হয়েছে ৫০ লাখ টাকার মতো। তিনি জানান, তাঁর প্রতিষ্ঠানটির বছরে গড়ে ৬৫ লাখ টাকা আয় হয়।

হান্নান জানান, আগের তুলনায় ডলারের দাম অনেক বেড়েছে। তাতে আমদানি করা কাঁচামালের দামও উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। সব মিলিয়ে দুই বছরে ব্যবসায়ের খরচ বেড়েছে ৩০–৩৫ শতাংশ। অন্যদিকে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতির কারণে ভোক্তারাও অসুবিধায় রয়েছেন। এসব তাঁদের বিবেচনায় রাখতে হচ্ছে।

আর কে হান্নান বলেন, দেশে চামড়ার জ্যাকেটের বাজার এখনো খুব ছোট, কিন্তু সম্ভাবনাময়। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে এই খাতের পরিসরও বাড়বে। তবে এ জন্য চামড়াশিল্পে অর্থায়ন ও নীতিসহায়তা দেওয়া প্রয়োজন।

ইউটিউব সাবস্ক্রাইব করুন

এই সাইটে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।