মঙ্গলবার
৫ই আগস্ট, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২১শে শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

দেশের শ্রমবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে

0Shares

দেশ বর্তমানে যে চ্যালেঞ্জগুলোর সম্মুখীন, তার মধ্যে বেকারত্ব অন্যতম। বেকারত্ব দূরীকরণে প্রয়োজন পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান। কিন্তু বাস্তবতা হলো, গত দেড় দশকে সেভাবে কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধি হয়নি। এমনকি তথাকথিত উচ্চ প্রবৃদ্ধির সময়েও জিডিপির অনুপাতে কর্মসংস্থান বাড়েনি। আবার শ্রমবাজারে শোভন চাকরির অভাব রয়েছে। কর্মে নিয়োজিতদের সিংহভাগই রয়েছেন অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। ঋণ প্রবৃদ্ধি না হওয়া, বিনিয়োগস্বল্পতা, জ্বালানির অভাব ইত্যাদি কারণে বেসরকারি খাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়নি। তবে সরকারি খাতে যে কর্মসংস্থান বেড়েছে, এমন নয়। এদিকে প্রতি বছর দেশে বিপুলসংখ্যক উচ্চশিক্ষিত তরুণতরুণী শ্রমবাজারে আসছেন। কিন্তু তারা শ্রমবাজারে নেই। এর প্রধান কারণ দেশের অর্থনীতির বড় অংশ এখনো অপ্রাতিষ্ঠানিক। উচ্চশিক্ষিতরা উৎপাদন খাত কারখানা পর্যায়ে কাজ করতে সেভাবে আগ্রহী নন। আবার বেসরকারি সরকারি চাকরিতে সুযোগসুবিধাজনিত ব্যবধান বাড়ায় তরুণরা ঝুঁকেছেন সরকারি চাকরির প্রতি। যদিও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপ২০২৩ অনুযায়ী, কেবল শতাংশ কর্মরত সরকারি চাকরিতে। যেখানে দেশে কোনো না কোনো কাজে যুক্ত থাকার মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করছেন সাত কোটির বেশি মানুষ, সেখানে সরকারি চাকরিতে জনবলের সংখ্যা হতাশাব্যঞ্জক। মূলত এটিও নির্দেশ করে দেশে প্রাতিষ্ঠানকি কর্মসংস্থানের অভাবকে। বিবিএসের ওই জরিপে বলছে, দেশে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে যুক্ত শ্রমজীবীর হার ৮৪ শতাংশ। আর প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করছেন মাত্র ১৬ শতাংশ। বাস্তবতায় সরকারের প্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। শোভন কর্মসংস্থান সৃষ্টি বেকার সমস্যার সমাধানে সহায়ক হবে বলে আশা করা যায়।

  তবে একই সঙ্গে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সরকারি খাতে কর্মে নিয়োজনের সংখ্যা বাড়ানো দরকার। সরকারি শূন্যপদের দিকে লক্ষ করলে বোঝা যায়, কিছু কৌশলী পদক্ষেপ নেয়ার মাধ্যমে খাতে জনবল বাড়ানো সম্ভব যা বেকারত্বের হারও কমিয়ে আনবে। জনপ্রশাসন সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে সরকারি চাকরিতে লাখ ৭৩ হাজার ১টি পদ শূন্য রয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব শূন্যপদগুলো পূরণের ব্যবস্থা করতে হবে।

  বিশেষজ্ঞদেরও মত, দেশে সরকারি চাকরিজীবীর হার বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় কম। তাই খাতে আরো বেশি লোকবল প্রয়োজন। শিক্ষা, স্বাস্থ্য আইনশৃঙ্খলার মতো জায়গায়ও আরো জনবল প্রয়োজন। তাছাড়া সরকারি খাতে জনবল কম থাকার বেশকিছু জটিলতা রয়েছে। বিভিন্ন খাতে সেবা প্রদান নীতিমালা বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হয়। সরকারি খাতে পর্যাপ্ত জনবল না থাকলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, আইনশৃঙ্খলা এবং সামাজিক নিরাপত্তাসেবার মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোয় সেবা প্রদান বাধাগ্রস্ত হয়। সরকারিভাবে প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ বাড়াতে উন্নয়ন পরিকল্পনায় শ্রমঘন শিল্পে বিনিয়োগ বাড়ানোও অপরিহার্য। উন্নয়ন পরিকল্পনায় বিষয়গুলোকে যুক্ত করা গেলে প্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থান বাড়ানো সম্ভবপর।

মূলত অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মে নিশ্চয়তা নিয়ে ঝুঁকি রয়েছে এবং মজুরিও তুলনামূলক কম থাকায় খাতে উচ্চ শিক্ষিত তরুণরা যুক্ত হতে চান না। যদিও সরকারি চাকরিতে পর্যাপ্ত সুযোগ না থাকায় একসময় মানুষ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের দিকে ঝুঁকে পড়েন। এতে কেবল শ্রমজীবীরা ক্ষতিগ্রস্ত হন, তা নয়। সরকারের রাজস্ব আয়ে বরং নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এরই মধ্যে দুর্নীতি অনিয়মের কারণে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের আকার দিন দিন বেড়েই চলেছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানে সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর অন্যতম বাংলাদেশ। তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক হিসাব অনুযায়ী, ২০১০ সালে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত থেকে পাওয়া যেত না এমন করের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা; ২০২১ সালে যা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৪ হাজার কোটিতে। অর্থাৎ ৮৪ হাজার কোটি টাকার কর ক্ষতি হচ্ছে। টাকা পাওয়া গেলে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যয় তিন গুণ বাড়ানো যেত। সুতরাং করজিডিপির অনুপাত বৃদ্ধিতেও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত একটি বড় বাধা। রাজস্ব আয় কম হলে উন্নয়ন ব্যয় স্বাভাবিকভাবেই কাটছাঁট করতে হয়। এতে অবকাঠামো মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এসব সমস্যা থেকে উত্তরণে সরকারের প্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন। এর জন্য শ্রমঘন শিল্পে বিনিয়োগের পাশাপাশি দক্ষতা বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন খাতে জনবল নিয়োগ পরিকল্পনা নিতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ বাড়েলে এটি শুধু সেবা প্রদানের মান বাড়বে না, বরং দেশের সার্বিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করবে।

তবে কেবল সরকারি খাতে নয়, বেসরকারি খাতের অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থানগুলোর সমস্যাগুলো দূর করার দিকে নজর দিতে হবে। কীভাবে তরুণদের সেসব খাতে চাকরির নিশ্চয়তা নিরাপত্তা দেয়া যা তা নিয়ে কাজ করার অবকাশ আছে। আবার বেসরকারি খাতের প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগগুলোর জন্য যেন দক্ষ শ্রমশক্তি পাওয়া যায়, সেজন্য স্নাতকধারীদের বিষয়ভিত্তিক বাস্তবিক জ্ঞান থাকা চাই। তবে বাস্তবতা হলো, দেশের কর্মক্ষম জনসংখ্যার বিচারে সবার জন্য চাকরির সুযোগ তৈরি করা সম্ভব নয়। তাই অধিকসংখ্যক উদ্যোক্তা তৈরির দিকেও নজর দিতে হবে। এজন্য অন্যতম সম্ভাবনাময় হতে পারে কৃষি খাত। আধুনিকায়ন, যথাযথ প্রশিক্ষণ উচ্চ মূল্যের কৃষিপণ্য উৎপাদনের সুযোগ থাকলে খাতে নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হবার সম্ভাবনা রয়েছে। এতে কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হবে।

বিবিএসের শ্রমশক্তি জরিপে উঠে আসা সমস্যাগুলোকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে না দেখে সম্ভাবনা হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। সরকারি খাতে জনবল বাড়ানো, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কর্মীদের প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধা নিশ্চিত করা এবং শিক্ষার সঙ্গে শ্রমবাজারের চাহিদার সেতুবন্ধ তৈরির মাধ্যমে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা সম্ভব। সরকারের বিনিয়োগ নীতিনির্ধারণে শ্রমঘন খাতকে প্রাধান্য দেয়া, প্রযুক্তি উদ্ভাবনে মনোযোগ দেয়া এবং সামাজিক নিরাপত্তার আওতা বাড়ানোর মাধ্যমে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক শ্রমবাজার নিশ্চিত হোকএটিই প্রত্যাশা।

ক্লিক করুন, আরো পড়ুন

ইউটিউব সাবস্ক্রাইব করুন

এই সাইটে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।